|| শিবরাত্রি ব্রত কথা ||
পুরাকালের কথা। তখন কৈলাস পর্বতের শিখর ছিল সর্বরত্নে অলংকৃত। ছায়াসুনিবিড় ফুলে-ফলে শোভিত বৃক্ষ, লতা ও গুল্মে ঢাকা। পারিজাতসহ অন্যান্য পুষ্পের সুগন্ধে চারদিক আমোদিত থাকত। এখানে সেখানে দল বেঁধে নৃত্য করত অপ্সরারা। ধ্বনিত হত আকাশগঙ্গার তরঙ্গ-নিনাদ। ব্রহ্মর্ষিদের কণ্ঠ থেকে শোনা যেত বেদধ্বনি।
এই কৈলাসশিখরে শিব-পার্বতী বাস করতেন। গন্ধর্ব, সিদ্ধ, চারণ প্রভৃতি তাঁদের সেবা করত। পরম সুখে ছিলেন শিব-পার্বতী। একদা পার্বতী শিবকে প্রশ্ন করলেন,
“ভগবান, আপনি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ-দাতা। আপনি কোন ব্রত বা তপস্যায় সন্তুষ্ট হন?”
দেবী পার্বতীর কথা শুনে শিব বললেন, “দেবী, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথির রাত্রিকে শিবরাত্রি বলা হয়। এ রাত্রিতে উপবাস করলে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হই। স্নান, বস্ত্র, ধূপ, পুষ্প ও অর্চনায় আমি যতটুকু সন্তুষ্ট হই, তার চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হই শিবরাত্রির উপবাসে।”
“ব্রতপালনকারী ত্রয়োদশীতে স্নান করে সংযম পালন করবে। স্বপক্ব নিরামিষ বা হবিষ্যান্ন ভোজন করবে। স্থণ্ডিল (ভূমি বা বালু বিছানো যজ্ঞবেদী) অথবা কুশ বিছিয়ে শয়ন করে আমার (অর্থাৎ শিবের) নাম স্মরণ করতে থাকবে। রাত্রি শেষ হলে শয্যা ত্যাগ করে প্রাতঃক্রিয়াদি ও অন্যান্য আবশ্যক কার্যাদি করবে। সন্ধ্যায় যথাবিধি পূজাদি করে বিল্বপত্র সংগ্রহ করবে। তারপর নিত্যক্রিয়াদি করবে। অতঃপর স্থণ্ডিলে (যজ্ঞবেদীতে), সরোবরে, প্রতীকে বা প্রতিমায় বিল্বপত্র দিয়ে আমার পূজা করবে। একটি বিল্বপত্র দ্বারা পূজা করলে আমার যে প্রীতি জন্মে, সকল প্রকার পুষ্প একত্র করে কিংবা মণি, মুক্তা, প্রবাল বা স্বর্ণনির্মিত পুষ্প দিয়ে আমার পূজা করলেও, তার সমান প্রীতি জন্মে না।
প্রহরে প্রহরে বিশেষভাবে স্নান করিয়ে আমার পূজা করবে। পুষ্প, গন্ধ, ধূপাদি দ্বারা যথোচিত অর্চনা করবে। প্রথম প্রহরে দুধ, দ্বিতীয় প্রহরে দধি, তৃতীয় প্রহরে ঘৃত এবং চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে আমাকে স্নান করাবে এবং পূজা করবে। এছাড়া যথাশক্তি নৃত্যগীতাদি দ্বারা আমার প্রীতি সম্পাদন করবে।
হে দেবী, এই হল আমার প্রীতিকর ব্রত। এ ব্রত করলে উপবাস ও যজ্ঞের পুণ্য লাভ হয় এবং ষোল কলায় দক্ষতা জন্মে। এ ব্রতের প্রভাবে সিদ্ধি লাভ হয়। অভিলাষী ব্যক্তি সপ্তদ্বীপা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়।”
শিব পার্বতীকে আরও বলেন, “এবার শিবচতুর্দশী তিথির মাহাত্ম্য বলছি, শোনো।
একদা সর্বগুণযুক্ত বারাণসী পুরীতে ভয়ঙ্কর এক ব্যাধ বাস করত। বেঁটে-খাটো ছিল তার চেহারা, আর তার গায়ের রং ছিল কালো। চোখ আর চুলের রং ছিল কটা। নিষ্ঠুর ছিল তার আচরণ। ফাঁদ, জাল, দড়ির ফাঁস এবং প্রাণী হত্যার নানা রকম হাতিয়ারে পরিপূর্ণ ছিল তার বাড়ি।
একদিন সে বনে গিয়ে অনেক পশু হত্যা করল। তারপর নিহত পশুদের মাংসভার নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হল। পথে শ্রান্ত হয়ে সে বনের মধ্যে বিশ্রামের জন্য একটি বৃক্ষমূলের নিচে শয়ন করল এবং একটু পরেই নিদ্রিত হল।
সূর্য অস্ত গেল। এল ভয়ঙ্কর রাত্রি। ব্যাধ জেগে উঠল। ঘোর অন্ধকারে কোনো কিছুই দৃষ্টিগোচর হল না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে একটি শ্রীফলবৃক্ষ অর্থাৎ বিল্ববৃক্ষ পেল। সেই বিল্ববৃক্ষে সে লতা দিয়ে তার মাংসভার বেঁধে রাখল। বৃক্ষতলে হিংস্র জন্তুর ভয় আছে, এই ভেবে সে নিজেও ঐ বিল্ববৃক্ষে উঠে পড়ল। শীতে ও ক্ষুধায় তার শরীর কাঁপতে লাগল। এভাবে সে শিশিরে ভিজেই জেগে কাটাল সারা রাত।
দৈববশত সেই বিল্ববৃক্ষমূলে ছিল আমার (অর্থাৎ শিবের) একটি প্রতীক। তিথিটি ছিল শিবচতুর্দশী। আর ব্যাধও সেই রাত্রি কাটিয়েছিল উপবাসে। তার শরীর থেকে আমার প্রতীকের ওপর হিম বা শিশির ঝরে পড়েছিল। তার শরীরের ঝাঁকুনিতে বিল্বপত্র পড়েছিল আমার প্রতীকের ওপর। এভাবে উপবাসে বিল্বপত্র প্রদানে এবং শিশিরস্নানে নিজের অজান্তেই ব্যাধ শিবরাত্রি ব্রত করে ফেলল।
দেবী, তিথিমাহাত্ম্যে কেবল বিল্বপত্রে আমার যে প্রীতি হয়েছিল, স্নান, পূজা বা নৈবেদ্যাদি দিয়েও সে প্রীতি সম্পাদন সম্ভব নয়। তিথি মাহাত্ম্যে ব্যাধ মহাপুণ্য লাভ করেছিল। পরদিন উজ্জ্বল প্রভাতে ব্যাধ নিজের বাড়িতে চলে গেল।
কালক্রমে ব্যাধের আয়ু শেষ হল। যমদূত তার আত্মাকে নিতে এসে তাকে যথারীতি যমপাশে বেঁধে ফেলতে উদ্যত হল। অন্যদিকে আমার প্রেরিত দূত ব্যাধকে শিবলোকে নিয়ে এল। আর আমার দূতের দ্বারা আহত হয়ে যমদূত যমরাজকে নিয়ে আমার পুরদ্বারে উপস্থিত হল। দ্বারে শিবের অনুচর নন্দীকে দেখে যম তাকে সব ঘটনা বললেন।
“এই ব্যাধ সারা জীবন ধরে কুকর্ম করেছে,” জানালেন যম।
তার কথা শুনে নন্দী বললেন, “ধর্মরাজ, এতে কোনো সন্দেহই নেই যে ঐ ব্যাধ দুরাত্মা। সে সারা জীবন অবশ্যই পাপ করেছে। কিন্তু শিবরাত্রি ব্রতের মাহাত্ম্যে সে পাপমুক্ত হয়েছে এবং সর্বেশ্বর শিবের কৃপা লাভ করে শিবলোকে এসেছে।”
নন্দীর কথা শুনে বিস্মিত হলেন ধর্মরাজ যম। তিনি শিবের মাহাত্ম্য ভাবতে ভাবতে যমপুরীতে ফিরে গেলেন। শিব পার্বতীকে আরও বললেন, “এই হল শিবরাত্রি ব্রতের মাহাত্ম্য।”
শিবের কথা শুনে পার্বতী বিস্মিত হলেন। তিনি এই তিথির মাহাত্ম্য নিকটজনদের কাছে বর্ণনা করলেন। তাঁরা আবার তা ভক্তিভরে পৃথিবীর বিভিন্ন রাজাকে জানালেন। এভাবেই শিবরাত্রি ব্রত পৃথিবীতে প্রচলিত হল।
|| মহাশিবরাত্রি পূজা বিধি ||
ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি শিবপুরাণ মতে মহাশিবরাত্রি। তাই ত্রয়োদশী তিথি থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় এই বিশেষ পূজার জন্য।
ত্রয়োদশী তিথিতে এক বেলা নিরামিষ আহার গ্রহণ করতে হয়, যাতে চতুর্দশী তিথিতে উদরে আহারের কণামাত্রও না থাকে।
শিবরাত্রির দিন ভোরেই ঘুম থেকে উঠে কালো তিল ভেজানো জলে স্নান করা বিধেয়, যাতে শরীর ও মন শুদ্ধ হয়।
স্নানের পর পূজার সংকল্প করতে হয়— “আমি শুদ্ধচিত্তে ও শুদ্ধশরীরে শিবরাত্রির ব্রত পালন করব।” এরপর “নমঃ শিবায়” মন্ত্রে প্রণাম জানিয়ে শিবের আশীর্বাদ কামনা করতে হয়।
অনেকেই দুপুরের মধ্যেই শিবপূজা করেন, কিন্তু মহাশিবরাত্রি পূজার আদর্শ সময় হল রাত। সারা রাত ধরে মহাদেবের ব্রতপালন করা হয়।